মানসিক রোগ : যে বিষবৃক্ষ পুষে রেখেছেন আপনার মনের ভিতরে

লেখাটা শুরু করবো আমার এক ফিনল্যান্ডের বন্ধুর উদাহরণ দিয়ে ,বন্ধু আমার সাইকেল নিয়ে বের হলো তবে ভুলে হেলমেট নেয়নি তো রাস্তায় পুলিশ আটকালো  জিজ্ঞাসা করলো যে তুমি হেলমেট ছাড়া কেন সাইকেল নিয়ে বের হয়েছো ? আমার বন্ধু কায়দা করে উত্তর দিলো আমি আসলে ডিপ্রেশনে (বাংলায় বিষণ্ণতা) ভুগছি এজন্য ভুলে গেছি একথা শুনে  পুলিশ সাথে সাথে বললো তুমি ডিপ্রেসড ও মাই গড ওয়েট আমি ডাক্তার ঠিক করে দিচ্ছি বলেই সে স্হানীয় সরকারী হাসপাতালে ফোন করে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে বললো তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করাতে।

এবার চিন্তা করুন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আপনি আপনার মা বাবা বা যাকেই বলুন না কেন বললে বলবে এই করো সেই করো শয়তানি ছাড়ো এইসব ডং ছাড়ো পড়ালেখায় মনোযোগ দাও তোমার এইসব ন্যাকামি আমরা বুঝি । 

উন্নত দেশগুলোতে শারিরিক অসুস্হতার পাশাপাশি মানসিক অসুস্হতাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয় কারণ হলো মানসিক ভাবে সুস্হ মানুষই আসলে দুনিয়াতে সফল মানুষ হয় কিন্তু আমাদের দেশে এসব সমস্যা বললে আপনাকে উল্টো পাগল বা মাথা খারাপ হয়ে গেছে এমন কিছু ভাবা শুরু করবে অথচ আপনার যেমন শারিরিক অসুস্হতা যেমন জ্বর টাইফয়েড এসব হতে পারে তেমন আপনার স্বাভাবিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে মানসিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে ।  শারীরিক অসুস্হতার যেমন ওষধ এবং চিকিৎসা আছে তেমনি মানসিক চিকিৎসারও ঔষধ এবং চিকিৎসা আছে । 

আমেরিকার ১৮% মানুষ মানসিক সমস্যাতে আক্রান্ত তবে ওদের অধিকাংশ মানুষই নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে সুস্হ হয়ে উঠে ,বাংলাদেশ মানসিক রোগ এর পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রায় এক কোটি মানুষ এর উপরে মানসিক সমস্যাতে আক্রান্ত কিন্তু চিকিৎসা নেবার হার একদমই কম । কাউকে নিজের কষ্টটা যন্ত্রণাটা বলতে না পারা কে কি ভাববে এসব চিন্তা করে এদেশে কেউ মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চায়না ।

আজকের লেখায় আমি প্রধান প্রধান কিছু মানসিক সমস্যা নিয়ে লিখবো যেগুলোতে মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ।



উদ্বেগজনিত রোগ বা এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার 

উদ্বেগ বা উদ্বিগ্ন থাকাটা মানুষের স্বাভাবিক জীবনেরই অংশ ,সামনে পরীক্ষা আসছে আপনি হয়তো পরীক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন ,সঠিক সময়ে কাজটা শেষ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে হয়তো আপনি চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন । সত্যি কি উদ্বিগ্ন হওয়াটা কোন মানসিক সমস্যা ? না মানসিক সমস্যা না কারণ এটা মানুষের জীবনের অংশই কিন্তু মানসিক সমস্যা তখন যখন এটা স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে যায় যার ফলে আপনার প্রতিদিনের কাজকর্মগুলো করতে সমস্যা হচ্ছে । আপনাকে বলা হলো দশ তারিখের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে এটা শুনেই আপনি ভয়ে আর দুশ্চিন্তায় এতটা অসুস্হ হয়ে পড়লেন কাজটাই আর হলোনা , সাধারণ মানুষ যে বিষয়টাকে যে লেভেলে দেখে আপনি এটাকে অনেক চিন্তা আর ভয় নিয়ে দেখছেন ।। আপনাকে বলা হলো বাজার করে নিয়ে আসতে আপনি বাজার করে আসতে পারবেন কিনা এটা নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা ভয় পাওয়া শুরু করে দিলেন অথচ একজন সাধারণ মানুষ এ নিয়ে এতটা দুশ্চিন্তা করে না ,আপনাকে বলা হলো স্টেজে গিয়ে কিছু বলতে আর আপনি এটা শুনেই ঘামে অস্হির হয়ে গেলেন কি বলবেন ভেবে,আপনি যেকোন কাজের আগেই চিন্তিত যে মানুষ কি ভাববে ? সব কাজের আগেই কেমন যেন ভয় ভয় দুশ্চিন্তার একটা ভাব চলে আসে আপনার ভিতর ।। যদি আপনার নিজেকে মনে হয় আপনি কোন কাজ নিয়ে স্বাভাবিক মানুষের  চেয়ে বেশি উদ্বেগ বা টেনশন করেন তাহলে আপনি এ্যংজাইটি ডিসঅর্ডারে অাক্রান্ত । এ ধরনের মানসিক রোগে বেশকিছু শারিরিক উপসর্গ দেখা দেয় তা হলো মাথা ঘোরানো, মাথা ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, জিভ শুকিয়ে যাওয়া, গিলতে কষ্ট হওয়া, ঘাড়ে ব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট, বুক ধড়ফড় করা, পেট ফাঁপা, বারবার প্রস্রাব হওয়া, বেশি ঘাম প্রভৃতি। 

অনেক সময় দেখা যাবে আপনি নিজেই বুঝতেছেন আপনি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করছেন কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেন না । এজন্য আপনাকে একজন ভালো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হবে ।। সঠিক চিকিৎসায় এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ।

শুচিবাই বা Obsessive-compulsive disorder (OCD)

এটাও এক ধরনের এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, এ ধরনের রোগীর সমস্যা হলো অযথা/কনফিউজড/অনিয়ন্ত্রিত চিন্তা ভাবনা করা যেমন বাথরুম থেকে বের হয়ে মনে করলেন আমি কি পানির কলটা বন্ধ করেছি ?,বাসায় এসে মনে হলো আমি কি গেইটে তালা দিয়ে এসেছি নাকি খোলা রেখে চলে এসেছি ? বার বার কোন কাজ করা যেমন বাথরুম থেকে বের হয়ে মনে হলো ধুর ঠিকমত মনে হয় গোসলটা হয়নি আবার গোসল করা ,ঘরের দরজা ঠিকমত লাগিয়েছেন কিনা তা বার বার চেক করা ,বার বার হাত ধোঁয়া,একই কথা বার বার বলতে থাকা ইত্যাদি।

স্বাভাবিক জীবনে হয়তো আমাদের সবারই একটু আধটু শুচিবাই আছে কিন্তু যখন এটা বার বার হতে থাকবে যেমন প্রতিদিনই বাসায় এসে মনে হয় তালা কি ঠিকমত লাগিয়েছিলাম ? তাহলে বুঝতে হবে আপনি এ রোগের দিকেই যাচ্ছেন হয়তো আপনিও বুঝতে পারছেন যে্ আপনি যা করছেন তা  ভুল বা অতিরিক্ত কিন্তু আপনি চাইলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না । দেরি না করে ডাক্তার দেখান সঠিক ঔষধ এবং কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে এটা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব যদি ভাবেন নিজে নিজে সুস্হ হয়ে যাবেন তাহলে বোকামী করবেন ।।

মুড ডিসঅর্ডার 

এটা একটা অদ্ভুত রোগ ভাই ,এই রোগে আক্রান্তরা যখন খুশি থাকে তখন খুব খুশি থাকে আর যখন কষ্টে থাকে তখন খুব কষ্টে থাকে ।। এই রোগে আক্রান্তদের দুইটা চেহারা একটা খুব খুশি আরেকটা খুব বেজার অথার্ৎ সাধারণ মানুষের মতো মাঝামাঝিতে কখনো অবস্হান করেনা  । যখন খুশি থাকে তখন  নিজেকে সুপারম্যান মনে হয় ,মুখে কথার খই ফুটতে থাকে ,উত্তেজনায় টববগ অবস্হা মনে হয় এই দুনিয়াটা জয় করে ফেলাতো হাতের মোয়া ,নানা ধরনের কাজ কর্ম শুরু করে দেয় সব একসাথে করে ফেলবে ইত্যাদি আর যখন মানুষটা বেজার থাকে তখন দুনিয়াটা অর্থব মনে হয় কাজ কর্মে সব উৎসাহ কোথায় যেন হারিয়ে যায় ,সব কিছুতে কেমন অনাগ্রহ চলে আসে ,নানা বিষয়ে দুশ্চিন্তা মাথায় আসে নিজেকে অনেক একা মনে হয় ,খুশি থাকা অবস্হায় যেসকল চিন্তাভাবনা করেছিলেন তার উল্টো ফিলিংসটা চলে আসে সবকিছুতে । এ ধরনের মানুষদের আত্নহত্যার প্রবণতা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ।

উপরের লেখাগুলো পড়ে যদি মনে হয় যে আপনি এতে আক্রান্ত তাহলে আর দেরি করবেন না দ্রুত কোন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞকে দেখান ।। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব ।।

সাইকোটিক ডিসঅর্ডার 

এটা মারাত্নক এক মানসিক সমস্যা ,এ ধরনের সমস্যাটাকে আমাদের মতো সমাজে সরাসরি পাগল হয়ে গেছে বলে ফেলে । এ রোগে আক্রান্ত রোগী হঠাৎ হঠাৎ গায়েবী কথার আওয়াজ শুনে ,পাখির আওয়াজ শুনে অথচ বাস্তবে যেটা সত্য নয় । নিজে নিজে হাসে নিজে নিজে কাদে ,কারো সাথে মিশতে চায়না ,মানুষ তার ক্ষতি করবে এ ধরনের চিন্তা করে সবসময় ,নিজেকে বিশেষ ক্ষমতাবান মনে করে ।।  এ ধরনের রোগীর সমস্যাগুলো আস্তে আস্তে ডেভেলেপ করে সুস্হ থেকে আস্তে আস্তে অসুস্হের দিকে যায় তাই যখনই এই ধরনের কোন লক্ষণ প্রকাশ পাবে সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন ।।

ডিপ্রেশন 

এটা খুব কমন একটা সমস্যা ,জীবন নিয়ে হতাশা চলে আসাটাই হলো ডিপ্রেশন । জীবনটা অর্থহীন মনে করা ,কোন কিছুতে উৎসাহ না পাওয়া ,মনে হচ্ছে জীবনটাকে আপনি জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ।। এ ধরনের রোগীর যেসব সমস্যা হয় প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠা নাস্তা করা খাওয়া দাওয়া অফিস করা  কাপড় চোপড় ধোঁয়া এসব দৈনন্দিন কাজগুলোকে বোঝা মনে হওয়া , কোন কিছুতে উৎসাহ না পাওয়া ,অল্পতেই ক্লান্তি অনুভব হওয়া,বন্ধুদের সাথে না মিশে একা থাকতে ভালো লাগা ইত্যাদি ।

ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের মধ্যে আত্নহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ,একটা সময় এসে এ ধরনের রোগীরা মনে করে এ জীবন রেখে লাভ কি অর্থহীন একটা জীবন ।। 

আসলে এ ধরনের রোগীরা যেভাবে ভাবে তাদের ভাবনাটাই ভুল কারো জীবনই অর্থহীন না মানসিক অসুস্হতার কারণে সে এভাবে চিন্তা করছে বা সবকিছুকে বোঝা হিসেবে দেখছে ।। সঠিক চিকিৎসা নিলে সুস্হ হয়ে আপনি হয়তো বলবেন লাইফ ইজ বিউটিফুল :)


মনে রাখবেন শারিরিক অসুখের মতো মনের অসুখের চিকিৎসা আছে সুতরাং আপনার যদি মনে হয় আপনি স্বাভাবিকের বাইরে গিয়ে আচরণ করছেন , আপনি বুঝতে পারছেন আপনি ভুল করছেন কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেন না তাহলেই সমস্যা । দ্রুত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখালে সঠিক চিকিৎসা নিলে সব ধরনের মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে সাধারণ মানুষের মতো আচরণে ফিরে আসা সম্ভব ।


আপনি কিভাবে সাহায্য করতে পারেন ?

হ্যাঁ আপনি এ লেখাটি পড়ার পর মনে হলো না আপনি এতে আক্রান্ত নয় কিন্তু আপনি এ সম্পর্কে জানলেন আপনার চারপাশে অনেক মানুষ এমন পাবেন যিনি মানসিক সমস্যাতে ভুগছে হয়তো জীবন নিয়ে খুব হতাশ ।। এ ধরনের মানসিক সমস্যাতে ভুগছে আপনার আশেপাশে থাকে তাহলে তার কথাগুলো সময় নিয়ে শুনবেন সাহস দিবেন ডাক্তারের কাছে পাঠাবেন ,মানসিক সমস্যাতে ভুগছে এমন অধিকাংশ মানুষ নিজের ভিতর কথা চেপে রাখে কে কি ভাববে বলে কাউকে বলতে চায়না কিন্তু যদি কেউ মনোযোগ দিয়ে তার কথাগুলো শুনতো তাহলে হয়তো তার বুকের ভিতর জমে থাকা কষ্ট কিছুটা কমতো নিজেকে হালকা মনে করতো বেঁচে থাকার সাহস পেতো ।।

পিজি হাসপাতালে প্রতিদিন  বিকাল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা মাত্র দুইশ টাকা চার্জের বিনিময়ে মানসিক রোগী দেখেন ভাই সময় না নস্ট করে ডাক্তার দেখান এখান থেকে ডাক্তারের লিস্টি পাবেন ,আগে সিরিয়ালের দরকার নেই 



আই রিপিট আপনার যদি মনে হয় আপনি কোন মানসিক সমস্যাতে ভুগছেন এবং তা আপনার জীবনে খুব প্রভাব ফেলছে জীবনে বিষিয়ে তুলছে তাহলে একটুও দেরি করবে না দ্রুত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরাপন্ন হোন ।।

বাংলাদেশে ভালো কোন সাইক্রিস্ট/মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ খুজে পাওয়াটাই কঠিন ,এখানে আপনারা কিছু ডাক্তারের ঠিকানা পাবেন চাইলে উনাদেরকে দেখাতে পারেন 

সতর্কতা : অনেকক্ষেত্রে এ ধরনের লেখা পড়ার পর অনেকের  মনে হয় আরে আমারতো এ সমস্যা আছে তাই সত্যিকার অর্থে আপনার সমস্যাগুলো আছে কিনা তার মাত্রা কতটুকু এবং তা আপনার জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলছে সেটা নিশ্চিত হতে ভালো চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিবেন ।

এছাড়াও যদি কোন সাহায্যের দরকার হয় আমাকে ফেইসবুকে নক করতে পারেন 


5 comments:

Md Tanjil said...

Great starting, hoping for more :)

Unknown said...

ভাই আমি অনেক ভয় পাই।

Biplob shan said...

nice

Unknown said...

ভালো লিখেছেন ভাই। অনেক কাজের একটা লেখা।

Unknown said...

আমার মনটা ভাল থাকে না।

Post a Comment

লেখাটি শেয়ার করুন