ফিঙ্গারপ্রিন্টের আবিষ্কার ও বাঙ্গালীর কৃতিত্ব গোপন করার ইতিহাস

রতিটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ ভিন্ন, কারও সাথে কারও আঙ্গুলের ছাপের কোন মিল নেই । আঙ্গুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে বর্তমানে ধরা পড়ছে অপরাধী ,প্রতিটি মানুষেরও আলাদা আলাদা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে । আজকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কারের ইতিহাস ও বাঙ্গালীর কৃতিত্ব তুলে ধরবো।

কোন কিছুর উপর হাত রাখলে সেখানে যে প্রায় অদৃশ্য একটি ছাপ পড়ে যায় এ বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ সর্বপ্রথম জানতে পারে প্রায় ২০০ বছর আগে ।

১৮৫৯ সালে ভারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিটিশ স্যার উইলিয়াম হারশেলস প্রথম আবিষ্কার করেন যে সময়ের সাথে সাথে মানুষের আঙ্গুলের ছাপের কোনো রদবদল ঘটে না, বরং একই থাকে তারপর ১৮৭৭ সালে তিনি স্বাক্ষরের মাধ্যম হিসেবে আঙ্গুলের ছাপও দেয়ার নিয়ম হুগলী জেলায় প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮৮০ সালে খ্যাতনামা বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘Nature’-এ প্রকাশিত এক চিঠিতে ইংরেজ দুই বিজ্ঞানী হেনরি ও উইলিয়াম হার্শেল প্রথমবারের মতো পুরো দুনিয়াকে জানান যে প্রতিটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ ভিন্ন একজনের সাথেআরেকজনের কোন মিল নেই এবং তা সহজে মুছে যায়না।

এরপর ১৮৯২ সালে , স্যার ফ্রান্সিস গ্যাল্টন প্রকাশ করেন ফিঙ্গার প্রিন্টস নামের যাতে বহু তথ্যসমৃদ্ধ ও আলোচিত বই তিনি এই বইয়েন আঙ্গুলের ছাপের শ্রেণীবিন্যাস করেছিলেন।

 

গ্যাল্টনের করা এই শ্রেনীবিন্যাসকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যান স্যার হেনরী। তার এই শ্রেণীবিন্যাস অপরাধবিজ্ঞানে ‘হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম’ নামে পরিচিত। এই শ্রেণীবিন্যাসের মাধ্যমে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেমের জন্য স্যার হেনরি ব্রিটেন ও সারা বিশ্বে বহু সম্মাননা লাভ করেন। অপরাধবিজ্ঞানে অভূতপূর্ব এই অবদানের সব কৃতিত্ব হেনরীর ভাগ্যে জুটে । কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই শ্রেণীবিন্যাস কিন্তু পুরোপুরি তার অবদান নয়। তিনি ছিলেন শুধুমাত্র এর তত্ত্বাবধায়ক। তার তত্ত্বাবধায়নে কাজি আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসু নামের দুই মেধাবী বাঙ্গালী সন্তান করেছিলেন কাজটি ,যা তখন বেমালুম চেপে যান স্যার হেনরী।কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকেনা তা প্রকাশ পাবেই পাবে , বিশ্বের কাছে প্রকাশ পায় ১০০ বছরেরও পর ,২০০৫ সালের কারেন্ট সায়েন্স সাময়িকীর এক দীর্ঘ গবেষনামুলক প্রতিবেদনে ।

কাজী আজিজুল হক

নাম কাজি সৈয়দ আজিজুল হক জন্ম বাংলাদেশের খুলনাতে । সময় ১৮৯২ সাল, স্যার হেনরি তখন ফিঙ্গারপ্রিন্টের শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে খুবই আগ্রহী সে তার এই কাজে নিয়োগ করলেন দুই মেধাবী বাঙ্গালী আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসুকে । দিন রাত পরিশ্রম করে আজিজুল নির্মাণ করলেন সিস্টেমটির মূল গাণিতিক ভিত্তি। তিনি একটি বিশেষ গাণিতিক ফর্মুলা আবিষ্কার করলেন।এই ফর্মুলার আলোকে তিনি আঙুলের ছাপের ধরনের ওপর ভিত্তি করে বানালেন ৩২টি সারি, এবং সেই ৩২টি সারিতে সৃষ্টি করলেন এক হাজার ২৪টি খোপ। এভাবে তিনি তার কর্মশালায় সাত হাজার আঙ্গুলের ছাপের বিশাল এক সংগ্রহ গড়ে তুললেন। তার সহজ-সরল এই পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপ সংখ্যায় লাখ লাখ হলেও শ্রেণীবিন্যাস করার কাজ সহজ করে দেয়। এদিকে হেমচন্দ্রও কিন্তু বসে থাকেনি আঙ্গুলের ছাপের টেলিগ্রাফিক কোড সিস্টেম প্রণয়ণ করলেন তিনি।

কিন্তু এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব চলে যায় এই কাজের তত্বাবধায়ক স্যার হেনরির । সারা বিশ্বব্যাপী তখন স্যার হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম এর গ্রহণযোগ্যতা শুরু হয় এবং অপরাধী সনাক্ত করণে এই সিস্টেম বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পায় । ১৯০১ সালে সর্বপ্রথম এটি স্কটলন্ড পুলিশ অপরাধীকে সনাক্ত করণে ব্যবহার করা শুরু করেন ।

স্যার হেনরী

তবে সে সময়ে আজিজুল হকের অবদান পুরোপুরি অস্বীকারও করা হয়নি ১৯১৩ সালে তিনি ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘খান সাহেব’, এবং ১৯২৪ সালে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন। বিশেষ জমি লাভ করেন এবং ৫০০০ টাকাও পুরষ্কার হিসেবে পান । এমনকি পুলিশ বাহিনীতেও তিনি বিশেষ সম্মানের সাথে চাকুরী করে হোন এসপিও । ।

তবে ইতিহাস ঘেটে পাওয়া যায় বিবেকের জ্বালা হোক বা অন্য কারণ হোক হেনরি ১৯২৬ সালের ১০ মে ইন্ডিয়া অফিসের তখনকার সেক্রেটারি জেনারেলকে এক চিঠি মারফত এই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দেন সে লিখে আমি স্পষ্ট করে জানাতে চাই ফিঙ্গারপ্রিন্টের শ্রেণীবিন্যাস ও তা নিখুত করণে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে আমার কর্মচারী আজিজুল হকের ,তার এই পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং বেশিরভাগ দেশ তা গ্রহণও করেছে

২০০১ সালের বিজ্ঞানী কলিন বিভানের আঙ্গুলের ছাপ বিষয়ক একটি বই ও কারেন্ট সায়েন্স সাময়িকীর ২০০৫ সালের সংখ্যায় ‘দ্য ফরগটেন ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ারস অব ফিঙ্গারপ্রিন্ট সায়েন্স’ শীর্ষক দীর্ঘ নিবন্ধে আজিজুল ও হেমচন্দ্রকে নিয়েব বিস্তারিত লেখা হয় যার কারণে বিশ্বব্যাপী তাদের নিয়ে নতুন আগ্রহের সৃষ্টি হয় ।

১৯৩৫ সালে এই কৃর্তীমান বাঙ্গালী মারা যান এবং বিহারের তাঁর নিজের বাড়ি ‘আজিজ মঞ্জিল’-এর সীমানার মধ্যে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

0 comments:

Post a Comment

লেখাটি শেয়ার করুন