নেপাল হলো ট্রেকার আর পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য,বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বত এভারেস্টসহ চমৎকার সব আকাশছোয়া পাহাড় পর্বতে ভরপুর এ নেপাল,যা দেখার নেশায় প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক পাড়ি জমায় এখানে। এবিসি বা অন্নর্পুর্না বেইজ ক্যাম্প ট্রেক তেমনই জনপ্রিয় একটা ট্রেকিং ডেস্টিনেশন।
এবিসি ট্রেকে আপনি ৪১৩০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত ট্রেকিং করে যেতে পারবেন আর চোখ মন ভরে দেখতে পারবেন অন্নপূর্ণার নজরকাড়া মায়াবী রুপ । আমি সম্প্রতি নেপালের এবিসি ট্রেকটি সম্পূর্ণ করেছি তাই অভিজ্ঞতার আলোকে আপনাদের জন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইনের ব্লগটি তৈরি করলাম।
অন্নপূর্ণার সামনে আমাদের টিম |
পুরো ট্যুরের এ্যালবামটি আপনারা ফেইসবুকে দেখে নিতে পারেন এখানে ক্লিক করে
প্রথমে ভিসার কথা বলবো ,নেপালে বাই এয়ারে যেতে কোন ধরনের অগ্রিম ভিসা নিতে হয়না আপনি যখন নেপালের কাঠমুন্ডুর ত্রিভুবন বিমান বন্দরে নামবেন তখনই কর্তুপক্ষ আপনাকে তাৎক্ষণিক ১৫/৩০ দিনের ভিসা দিয়ে দিবে। আপনার পাসপোর্ট সাথে দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি হলেই হবে। সার্ক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পর্যটকদের জন্য কোন ধরনের ভিসা ফি নেই মানে একদম ফ্রিতে পাচ্ছেন ভিসাটি।
আর এখন করোনা আছে বলে একটা ফরম পুরণ করে নিবেন যার নাম সিসিএমসি ফর্ম আমি লিংক দিয়ে দিচ্ছি ভবিষ্যতে এটা লাগবে কিনা তা আপনি যেখান থেকে এয়ার টিকেট করবেন তারা বলে দিতে পারবে তবে বর্তমানে লাগে।
ফর্ম লিংক এই লিংকে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলার এরাইভাল ফর্মে ক্লিক করলে একটা ফর্ম আসবে সেটাতে আপনার বিস্তারিত দিয়ে পুরণ করে প্রিন্ট করে নিবেন তাহলেই হবে। এখানে এড্রেস ইন নেপাল ও ফোন নাম্বারের ঘরে নেপালের যেকোন একটা হোটেলের নাম ফোন নাম্বার কপি করে পেস্ট করে দিলেই হবে গুগল থেকে।
কয়দিন লাগে এবং আনুমানিক খরচ :
যদি আপনি স্ট্যান্ডার্ট ভাবে ঘুরতে যান তাহলে আপনার এটা শেষ করতে ঢাকা থেকে ঢাকা ৯ রাত ১০ দিন লাগবে। এক্ষেত্রে আপনার দক্ষতার উপরে নির্ভর করে ১/২দিন বাড়াতে পারেন আবার কমাতেও পারেন তবে এর চেয়ে কমে করতে গেলে প্রেসার হয়ে যাবে। পুরো পোস্টটি পড়লে আরও ধারণা হয়ে যাবে আপনার কতদিন লাগবে। আমরা ৯ রাত ১০ দিনে শেষ করে এসেছি। তবে ফেরার সময় এক দুইদিন সময় বাড়িয়ে কাঠমুন্ডু ও আশেপাশের ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ঘুরে আসতে পারেন ।
এবার আসি খরচে , খরচ বাই এয়ার খরচে আসা ও যাওয়া মিলিয়ে আপনার সর্বনিম্ন ২০ থেকে শুরু করে ২৫/২৬ হাজার টাকা লাগতে পারে। এয়ার টিকেট কবে কাটছেন কোন এয়ারে এসবের উপরে নির্ভর করে এয়ার ফেয়ার নির্ধারিত হয় । মুলত নেপালে যাবার জন্য বাংলাদেশ এয়ারের বিমান ভালো যা প্রতিদিন সকাল ৯:৪৫ মিনিটে ঢাকা থেকে ছাড়ে এবং আসার সময় দুপুর ১২টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ে। আপনি আপনার সুবিধামত এয়ার টিকেট করে নিন।
এয়ার টিকেটের পর পরের বাকী অংশটি ঘুরে দেখার জন্য আপনার আনুমানিক ২৫-৩৫ হাজার টাকার মতো খরচ হতে পারে এটা নির্ভর করে আপনি কোন ধরনের খাবার খাচ্ছেন কই থাকছেন কতজন যাচ্ছেন কি ধরনের কমফোর্ট নিচ্ছেন এসবের উপরে। আমাদের জনপ্রতি খরচ হয়েছিলো এয়ার টিকেট ছাড়া ৩০ হাজার করে।
এখন একটা কথা আসে এই ট্রেকিং সবাই কি পারবে ?
এটা মুলত মডারেট লেভেলের কঠিন ট্রেকিং । যারা দেশে টুক টাক ট্রেকিং করেছেন বা হালকা পাতলা মনোবল ভালো বা হাটতে পারেন তাদের জন্য কোন সমস্যা নেই চলে যান হয়ে যাবে। তবে যারা বেশ মোট বা শহরের পরিবেশে বড় হয়েছে কখনো ট্রেকিং এ যাননি তারা এটা প্রথমেই যাওয়া ঠিক হবেনা আপনারা দেশে কিছু ট্যুর দিয়ে নিজেকে পরখ করে নিন।
এবার আসি ট্যুর প্ল্যান নিয়ে :
আমাদের ট্যুর প্ল্যান ছিলো অনেকটা এমন
- ১ম দিন : সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটের বাংলাদেশ বিমানে কাঠমুন্ডুর ত্রিভুবন আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা এবং সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দুপুর একটায় নেপাল বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে যাই । এখানে উল্লেখ্য ফ্ল্যাই টাইম মাত্র ১ ঘন্টা আর বাকী সময় ইমিগ্রেশনের নানা কাজে গেছে। বিমান বন্দর থেকে বের হয়ে ৪০০ রুপিতে ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেছি থামেলে। থামেল হলো কাঠমুন্ডুর প্রাণকেন্দ্র সেখানে ডলার গুলোকে রুপিতে কনভার্ট করে ট্রেকিং রিলেটেড কিছু কেনাকাটা করে সিম কিনে সোজা চলে গেছি ট্যাক্সি স্ট্যান্ড । ৮০০ রুপি করে টিকেট সময় ৬/৭ ঘন্টা লাগে সোজা পোখারা। সীম কেনা ও টাকা কনভার্ট উভয় কাজটিই আপনি বিমানবন্দরের ভিতরেই বুথ আছে সেখানেও আরামসে করতে পারবেন। সীম ও ডাটা প্যাকেজ সহ ৬০০-৭০০ রুপির মতো লাগে। মনে রাখবেন ১ ডলারে আমরা ১২৬ রুপি পেয়েছি সো সে হিসাব মতে নেপালী রুপির মান আমাদের চেয়ে কম। আনুমানিক রাত নয়টায় পৌছে একটা হোটেল দেখে সেখানে উঠে গেছি। আপনি মাইক্রোতেও যেতে পারবেন বা বাসেও যেতে পারবেন পোখারা। তবে আমরা চেয়েছি ওইদিনই পোখারা গিয়ে রাতটা থাকতে তাই মাইক্রোতে গিয়েছি কারণ বাস থেকে মাইক্রো দ্রুত পৌছায় । বাসে যেতে চাইলে রাতের বাসে যেতে পারেন সেক্ষেত্রে পরদিন ভোরে নামবেন গিয়ে।
- দ্বিতীয় দিন : সকালে উঠে পোখারা লেকে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলাম পোখারা অনেক সুন্দর সিটি এখানেও ট্রেকিং এর সব জিনিসপত্র পাবেন। দুপুরে আগে থেকে ঠিক করা একজন ড্রাইভার আমাদের ৬ জনকে পিক করে প্রথমে পারমিট অফিসে নিয়ে যায় সেখানে পাসপোর্ট ও নিজের ছবি দিয়ে ফর্ম ফিলাপ করে জনপ্রতি ১০০০ রুপি দিয়ে পারমিট কার্ড সংগ্রহ করি তারপর গান্দ্রুকের উদ্দেশ্য রওয়ানা হই । গান্দ্রুক থেকে ট্রেকিং শুরু হবে । পাহাড়ের কোলে গান্দ্রুক একটা চমৎকার জায়গা। প্রায় ৪ ঘন্টা পর আমরা গান্দ্রুক রিসোর্টে পৌছাই । তারপর ফ্রেশ হয়ে গান্দ্রুক ঘুরে দেখি এদিনটাও আমরা রিল্যাক্সেই কাটালাম । গান্দ্রুক যাবার লোকাল বাসও পাবেন । পোখারা বাস স্ট্যান্ড থেকে । লোকালদের জিজ্ঞাসা করলে দেখিয়ে দিবে।
- তৃতীয় দিন : আজ থেকে ট্রেকিং শুরু সবাই যেমন এক্সসাইটেড তার সাথে হাটার চিন্তা করে কিছুটা শংকিতও বটে । যাই হোক ঘান্দ্রুক থেকে আজকে যাবো আমরা চমরং যা আনুমানিক ৫-৬ ঘন্টার ট্রেকিং। প্রথম দিন ট্রেকিং এ কিছুটা কষ্ট হলেও যেহেতু সময় হাতে ছিলো তাই ধীরে সুস্থে সঠিক সময়ে আমরা বিকালের দিকে চমরং গিয়ে পৌছায় । চমরং এ অনেকগুলো গেস্ট হাউজ আছে। সবগুলো মুলত একই ধাচের আকাশ পাতাল প্রার্থক্য এখানে হয়না । আমরা প্যানোরোমা গেস্ট হাউজে উঠে পড়ি কারণ এটার ভিউ পয়েন্টা সুন্দর।
- চতুর্থ দিন :আজকে্ আমরা চমরং থেকে যাবো দোভান,পথটা কিছুটা লম্বা , চমরং থেকে লোয়ার সিনুয়া ,আপার সিনুয়া ও বেম্বো পাড়া পেরিয়ে আনুমানিক ছয়টায় আমরা পৌছাই দোভান।
- ৫ম দিন : আজকে আমাদের জন্য কঠিন দিন কারণ আজকে হাটা বেশি এবং প্রায় ১৩০০ মিটার উপরের দিকে উঠবো । দোভান ২৩০০ আর আমরা আজকে যাবো MBC ৩৭০০ মিটারে। আজকের দিনে খাড়া বেশি মুলত আজকে উপরের দিকেই উঠতে হবে সবচেয়ে বেশি। হাটি হাটি পা করে হিমালয়া পাড়া তে একটা রেষ্ট নিয়ে এক গ্লাস মহিষের দুধ খেয়ে হাটা শুরু করলাম তারপর আমরা যাবো দেউরালী পাড়া সেখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে এমবিসের উদ্দেশ্যে হাটা দিবো। দুপুরে পৌছে গরম গরম ভাত ডাল আর সবজি খেয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় পৌছাই গিয়ে এমবিসিতে ।
- ৬ষ্ঠ দিন : এদিন আমাদের এবিসি জয়ের পালা ,যেহেতু ভোরের দিকে অন্নপূর্ণার ভিউ সবচেয়ে ক্লিয়ার হবার চান্স থাকে তাই সবাই মুলত ভোরেই এবিসির দিকে রওয়ানা হয় আমরা ভোর সাড়ে চারটায় এবিসির দিকে হাটা দিলাম । আমরা মুলত বর্ষার সিজনে গিয়েছিলাম এসময়ে ভিউ ভালো পাবার চান্স তুলনামুলক কম থাকে তবে আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলাই যায় আমরা যখন হেটে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে ভোর হচ্ছিলো আর ধীরে ধীরে অন্নপূর্ণা তার বিশাল রুপ আমাদের সামনে তুলে ধরছিলো এবিসিতে পৌছানো পর্যন্ত প্রায় দুই ঘন্টা একদম ক্লিয়ার ভিউ পেয়েছি যা ওইসময়ে পাবার চান্স খুব কম থাকে। মন ভরে ছবি তুলে দেখে এবিসিতে গিয়ে নাস্তা করে আবার চলে আসছি এমবিসিতে। তখন সকাল দশটা। আজকে আমাদের টার্গেট ছিলো দোভানে আবার চলে আসবে যেহেতু দোভান এমবিসি থেকে পুরোটাই নীচের দিকে নামতে হয় তাই সময় কম লাগবে সে চিন্তায় আমরা এমবিসি থেকে হাটা দেই মজার কথা হলো আমরা যে সময়ে উঠেছিলাম তার অর্ধেকেরও কম সময়ে আমরা দোভান এসে পৌছাই যেহেতু নীচের দিকে নামতে হয় তাই তুলনামুলক অনেক সময় কম লেগেছে। তবে সবার ক্ষেত্রে এমনটা নাও হতে পারে যে ভোর ৪টায় উঠে আবার সারাদিন ট্রেকিং করা সেক্ষেত্রে এদিকে আপনারা কাস্টমাইজ করে একদিন এক্সটা সময় নিতে পারেন এক্ষেত্রে রিল্যাক্স হবে। রাতে এসে আমরা আবার দোভানে রাত্তিযাপন করি। যদি কারো কষ্ট হয় তাহলে মাঝখানে আরও দুইটা পাড়া আছে হিমালয়া ও দেওরালী সেগুলোতেও সুবিধামত থাকতে পারেন।
- সপ্তম দিন : দোভান থেকে আগের মতোই বেম্বো /লোয়ার ও আপার সিনুয়া পাড়া পার হয়ে চলে আসি চমরং আগের গেস্ট হাউজে এবং এখানে রাত্তি যাপন করার সিদ্ধান্ত নেই তবে শেষ মুহুর্তে আমরা এর ঠিক নীচে আরেকটা পাড়া আছে ঝিনু সেখানে চলে আসি কারণ একই পাড়ায় দুই রাত থাকার চেয়ে ভিন্ন পাড়ায় থাকার অভিজ্ঞতাটা নতুন হবে সে চিন্তায় । ঝিনুতেও চমৎকার একটা রিসোর্টে উঠি।
- ৮ম দিন : ঝিনু থেকে ৩০ মিনিট নীচের দিকে নামলে একটা চমৎকার চমৎকার জায়গা পাবেন নাম হট স্পিং অর্থাৎ পাহাড় থেকে গরম পানি বের হয় এবং জমা হয়ে এখানে ন্যাচারল একটা সুইমিং পুল তৈরি করেছে। অবশ্যই যাবেন মিস করবেন না এটাতে আমরা গিয়েছি এটা প্রাকৃতিক একটা বিস্ময় বলা যায় । আমরা গিয়ে বেশ সময় নিয়ে গোসল করেছি কারণ গরম পানিতে চমৎকার একটা আরামদায়ক গোসল হয়। যাই হোক সকাল হট স্পিং ঘুরে এসে আগে থেকে ঠিক করা গাড়ী চলে আসে ঝিনু পর্যন্ত । এখানে একটা বিশাল ঝুলন্ত ব্রিজ আছে যা দেখে নিতে পারেন। ঝিনু থেকে গাড়ীতে করে ৩ ঘন্টার মত সময় লাগে সোজা চলে আসি পোখারাতে। দীর্ঘ ট্রেকিং এর ধকলের কারণে সেদিন বিশ্রামেই যায় ।
- নবম দিন : এদিন পোখারাতে কিছু এক্টিভিটিজ করার সিদ্ধান্ত নেই কেউ প্যারাগ্লাইডিং কেউ রাফটিং আবার কেউ বান্জি করার সিদ্ধান্ত নেয় । এখানে সবই করতে পারবেন শহরের নানা প্রান্তে নানা এজেন্ট আছে যারা এগুলো বুকিং নেয় । এদিন রাতে আমাদের বাসের টিকেট করা ছিলো সন্ধ্যা ৮টায় বাসে উঠি পরদিন ভোরে কাঠমুন্ডু থামেলে নামিয়ে দেয় ।
- ১০ম দিন : ভোরে নেমে রুপিগুলো ডলারে কনভার্ট করে নেই ও থামেলে নাস্তা সেরে একটু এদিক সেদিক ঘুরে এয়ারপোর্টে চলে যাই দশটার দিকে । সাড়ে বারোটার ফ্ল্যাইটে চলে আসি ঢাকাতে । আনুমানিক দুইটার দিকে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে যে যার মতো বাসায় চলে আসি।
0 comments:
Post a Comment